ক্রোয়েশিয়া ইউরোপের একটি দারুণ ভ্রমণ গন্তব্য, যেখানে আছে সুন্দর সমুদ্র সৈকত, ঐতিহাসিক শহর, এবং চমৎকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। বিশেষ করে গ্রীষ্মকালে পর্যটকরা ক্রোয়েশিয়ায় ভিড় করেন এর মনোরম দ্বীপপুঞ্জ ও এড্রিয়াটিক সাগরের জন্য। তবে বাংলাদেশ থেকে কেউ যদি সেখানে ভ্রমণ করতে চান, স্বাভাবিকভাবেই একটি প্রশ্ন আসে ক্রোয়েশিয়া যেতে কত টাকা লাগে?আজকের এই নিবন্ধে আমরা বিস্তারিতভাবে জানবো ফ্লাইট, ভিসা, হোটেল, খাবার, এবং অন্যান্য খরচ নিয়ে।

ক্রোয়েশিয়া ভিসার খরচ

বাংলাদেশ থেকে ক্রোয়েশিয়া যেতে হলে শেনজেন ভিসা নিতে হয়, কারণ ক্রোয়েশিয়া ইউরোপীয় ইউনিয়নের শেনজেন অঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত। ভিসা পাওয়ার জন্য আবেদনকারীদের অবশ্যই সঠিক ডকুমেন্টেশন ও প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে হয়।

  • শেনজেন ভিসা ফি: প্রায় ৮০ ইউরো (প্রায় ৯,৫০০ টাকা)। এটি শুধুমাত্র ভিসার সরকারি ফি, যা প্রতিটি আবেদনকারীকেই দিতে হয়।
  • ভিসা প্রসেসিং চার্জ এবং সার্ভিস ফি: ভিসা সেন্টারের সার্ভিস ফি ও অন্যান্য প্রসেসিং খরচ ধরলে মোট খরচ দাঁড়ায় প্রায় ১২,০০০ – ১৫,০০০ টাকা।
  • ডকুমেন্টেশন খরচ: অনেক সময় ব্যাংক স্টেটমেন্ট, ইনস্যুরেন্স, ট্রাভেল বুকিং বা ফটোকপি ইত্যাদির জন্যও অতিরিক্ত খরচ হতে পারে।
  • অভিজ্ঞ এজেন্সির সাহায্য: অনেকেই ভিসা প্রসেসিংয়ে অভিজ্ঞ ট্রাভেল এজেন্সির সাহায্য নিয়ে থাকেন। এতে কাগজপত্র সাজানো, অ্যাপয়েন্টমেন্ট বুকিং, ইন্টারভিউ প্রস্তুতি ইত্যাদিতে সুবিধা হয়।

সঠিকভাবে কাগজপত্র প্রস্তুত করা ভিসা পাওয়ার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সামান্য ভুল বা অসম্পূর্ণ তথ্যের কারণে আবেদন বাতিল হতে পারে। তাই যাত্রার পরিকল্পনা করার আগে যথেষ্ট সময় হাতে রেখে আবেদন করা উত্তম।

বাংলাদেশ থেকে ক্রোয়েশিয়া ফ্লাইট টিকিটের দাম

ঢাকা থেকে ক্রোয়েশিয়ার রাজধানী জাগরেব বা স্প্লিটে সরাসরি কোনো ফ্লাইট নেই। যাত্রীদের সাধারণত ইস্তানবুল, দোহা বা দুবাই হয়ে কানেক্টিং ফ্লাইট নিতে হয়। জনপ্রিয় এয়ারলাইন্স যেমন Turkish Airlines, Qatar Airways, Emirates, Etihad Airways ইত্যাদি ঢাকা থেকে ক্রোয়েশিয়ায় যাত্রী পরিবহন করে থাকে।

  • ইকোনমি ক্লাস রিটার্ন টিকিট: প্রায় ৮০,০০০ – ১,১০,০০০ টাকা। আগেভাগে টিকিট বুক করলে তুলনামূলক সাশ্রয়ী মূল্যে পাওয়া যায়।
  • বিজনেস ক্লাস রিটার্ন টিকিট: প্রায় ২,৫০,০০০ – ৩,৫০,০০০ টাকা। বিজনেস ক্লাসে অতিরিক্ত লাগেজ সুবিধা, লাউঞ্জ অ্যাক্সেস এবং আরামদায়ক ভ্রমণের সুযোগ থাকে।
  • মৌসুমি ভাড়ার ওঠানামা: গ্রীষ্মকাল (মে – আগস্ট) ইউরোপে ভ্রমণের পিক সিজন হওয়ায় এ সময় টিকিটের দাম সাধারণত অনেক বেশি থাকে। অপরদিকে শীতকালে (নভেম্বর – ফেব্রুয়ারি) তুলনামূলক কম দামে টিকিট পাওয়া যায়।
  • কানেক্টিং সময়: ফ্লাইট রুট ও ট্রানজিট সময়ের উপর ভিত্তি করে মোট ভ্রমণ সময় প্রায় ১২ – ১৮ ঘণ্টা হতে পারে।
  কানাডা ভিসা আবেদন ফরম

যাত্রীরা চাইলে অনলাইন টিকিট বুকিং সাইট যেমন Skyscanner, Google Flights বা এয়ারলাইন্সের অফিসিয়াল ওয়েবসাইট ব্যবহার করে টিকিটের দাম তুলনা করতে পারেন।

ক্রোয়েশিয়ায় হোটেল খরচ

ক্রোয়েশিয়ায় হোটেল খরচ নির্ভর করে শহর, লোকেশন, হোটেলের মান ও মৌসুমের উপর। ডুব্রোভনিক, স্প্লিট ও জাগরেব পর্যটকদের কাছে জনপ্রিয় শহর হওয়ায় এসব জায়গায় থাকার খরচ তুলনামূলকভাবে বেশি।

  • বাজেট হোটেল বা হোস্টেল: প্রতি রাত ২০ – ৪০ ইউরো (প্রায় ২,৫০০ – ৫,০০০ টাকা)। ব্যাকপ্যাকার বা বাজেট ভ্রমণকারীদের জন্য উপযুক্ত। অনেক হোস্টেলে শেয়ারড রুম ও কমন কিচেন সুবিধাও থাকে।
  • মাঝারি মানের হোটেল: প্রতি রাত ৫০ – ১০০ ইউরো (প্রায় ৬,০০০ – ১২,০০০ টাকা)। পরিবার বা দম্পতির জন্য ভালো অপশন, যেখানে প্রাইভেট রুম, ফ্রি ব্রেকফাস্ট ও ওয়াই-ফাই সুবিধা থাকে।
  • বিলাসবহুল হোটেল বা রিসোর্ট: প্রতি রাত ১৫০ ইউরো থেকে শুরু (প্রায় ১৮,০০০ টাকা+)। এসব হোটেলে সুইমিং পুল, স্পা, সি-ভিউ, প্রাইভেট বিচ ইত্যাদি সুবিধা পাওয়া যায়।

মৌসুমি প্রভাব: গ্রীষ্মকালে (মে – সেপ্টেম্বর) পর্যটকদের ভিড় বেশি থাকায় হোটেলের ভাড়া প্রায় দ্বিগুণ পর্যন্ত বেড়ে যেতে পারে। শীতকালে বা অফ-সিজনে হোটেল ভাড়া অনেকটাই কমে যায়।

যারা দীর্ঘ সময় অবস্থান করতে চান তারা চাইলে Airbnb বা সার্ভিসড অ্যাপার্টমেন্ট বেছে নিতে পারেন, যা অনেক সময় হোটেলের চেয়ে সাশ্রয়ী হয়।

ক্রোয়েশিয়ায় খাবারের খরচ

ক্রোয়েশিয়ার খাবারের বৈচিত্র্য ইউরোপের অন্যান্য পর্যটন দেশগুলোর মতোই সমৃদ্ধ। এখানে ইতালিয়ান, মেডিটারেনিয়ান ও স্থানীয় ক্রোয়েশিয়ান খাবারের সমন্বয় পাওয়া যায়। পর্যটন শহরগুলোতে খাবারের দাম তুলনামূলক বেশি হলেও ছোট শহর বা লোকাল রেস্টুরেন্টে কম খরচে ভালো মানের খাবার পাওয়া যায়।

  • সাধারণ রেস্টুরেন্টে একবেলা খাবার: ৮ – ১২ ইউরো (প্রায় ১,০০০ – ১,৫০০ টাকা)। এসব রেস্টুরেন্টে সাধারণত পাস্তা, সালাদ, পিজ্জা বা চিকেন-ফিশের প্লেট পাওয়া যায়। একা ভ্রমণকারীদের জন্য এটি বেশ সাশ্রয়ী অপশন।
  • মাঝারি মানের রেস্টুরেন্টে দুই জনের জন্য তিন কোর্স মিল: ৩৫ – ৫০ ইউরো (প্রায় ৪,৫০০ – ৬,০০০ টাকা)। এটি দম্পতি বা পরিবারের জন্য উপযুক্ত। তিন কোর্স মিলে সাধারণত একটি স্টার্টার (সুপ/সালাদ), মেইন কোর্স (মাছ বা মাংস) এবং একটি ডেজার্ট থাকে। অনেক রেস্টুরেন্টে স্থানীয় ওয়াইনও যুক্ত হয়।
  • ফাস্ট ফুড: ৫ – ৭ ইউরো (প্রায় ৬০০ – ৯০০ টাকা)। বাজেট ট্রাভেলারদের জন্য এটি সাশ্রয়ী অপশন। বার্গার, স্যান্ডউইচ, পিজ্জা বা সাবওয়ে জাতীয় খাবার সহজেই পাওয়া যায়।
  • বাজার থেকে কিনে রান্না করা: সুপারমার্কেট যেমন Lidl, Konzum, বা Spar থেকে সস্তায় গ্রোসারি কেনা যায়। ২৫-৩০ ইউরো খরচে ২-৩ দিনের খাবার তৈরি করা সম্ভব। যারা এয়ারবিএনবি বা কিচেনসহ অ্যাপার্টমেন্টে থাকবেন তাদের জন্য এটি সবচেয়ে সাশ্রয়ী উপায়।
  জার্মানি কাজের ভিসা ২০২৫

ক্রোয়েশিয়ার ভেতরে যাতায়াত খরচ

ক্রোয়েশিয়ার ট্রান্সপোর্ট সিস্টেম পর্যটকবান্ধব। শহরের ভেতরে ঘোরাঘুরির জন্য পাবলিক ট্রান্সপোর্ট সেরা উপায় হলেও চাইলে ভাড়ায় গাড়ি নিয়েও ভ্রমণ করা যায়।

  • বাস বা ট্রামের টিকিট: ১.৫ – ২ ইউরো (প্রায় ২০০ টাকা)। রাজধানী জাগরেব ও বড় শহরগুলোতে বাস এবং ট্রামের নেটওয়ার্ক বেশ উন্নত। সাধারণত একটি টিকিট ৩০-৯০ মিনিট পর্যন্ত বৈধ থাকে, সেই সময়ের মধ্যে একই টিকিট দিয়ে একাধিকবার ট্রান্সপোর্টে উঠা যায়।
  • ট্যাক্সি: শুরু ৩ ইউরো এবং প্রতি কিলোমিটার প্রায় ১ ইউরো। তবে এয়ারপোর্ট থেকে শহরে যেতে হলে ভাড়া তুলনামূলক বেশি হতে পারে। ট্যাক্সি খরচ বাঁচাতে অনেকেই Uber বা Bolt ব্যবহার করেন।
  • সাইকেল বা স্কুটার ভাড়া: অনেক শহরে সাইকেল রেন্টাল সিস্টেম রয়েছে। দিনে ১০-১৫ ইউরোতে সাইকেল ভাড়া নেওয়া যায়। ইলেকট্রিক স্কুটারের খরচ মিনিটপ্রতি প্রায় ০.১৫ – ০.২০ ইউরো। এগুলো শহরের ভেতরে ছোট দূরত্বে ঘোরার জন্য উপযুক্ত।
  • শহরের মধ্যে ভ্রমণ (ইন্টারসিটি বাস/ট্রেন): জাগরেব থেকে স্প্লিট বা ডুব্রোভনিক পর্যন্ত বাসে যেতে প্রায় ২০-৩০ ইউরো খরচ হয়। ট্রেন তুলনামূলক ধীরগতির হলেও আরামদায়ক। যারা সময় বাঁচাতে চান তারা অভ্যন্তরীণ ফ্লাইটও নিতে পারেন।

ক্রোয়েশিয়ার জনপ্রিয় ট্যুরিস্ট স্পটের খরচ

ক্রোয়েশিয়ার সবচেয়ে বড় আকর্ষণ হলো এর ঐতিহাসিক শহর ও প্রকৃতি। এ কারণে জনপ্রিয় ট্যুরিস্ট স্পটগুলো ঘুরে দেখতে কিছু খরচ ধরতে হবে।

  • ডুব্রোভনিক সিটি ওয়াল: এন্ট্রি ফি প্রায় ৩০ ইউরো। ডুব্রোভনিককে বলা হয় “Pearl of the Adriatic”। শহরের প্রাচীন দেয়াল ধরে হাঁটলে সমুদ্রের অপূর্ব দৃশ্য ও মধ্যযুগীয় স্থাপত্য চোখে পড়বে।
  • প্লিটভিস লেক ন্যাশনাল পার্ক: টিকিট ২৫ – ৪০ ইউরো (মৌসুমভেদে পরিবর্তিত)। গ্রীষ্মে পর্যটকের চাপ বেশি থাকায় দাম বেশি থাকে। এখানে ১৬টি হ্রদ ও অসংখ্য জলপ্রপাত আছে, যা ইউরোপের অন্যতম প্রাকৃতিক সৌন্দর্য।
  • ডায়োক্লেটিয়ানের প্যালেস (স্প্লিট): টিকিট ১০ – ১৫ ইউরো। রোমান যুগে নির্মিত এই ঐতিহাসিক স্থাপনাটি ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট। এখানকার সরু গলি ও প্রাচীন আর্কিটেকচার দর্শনার্থীদের অতীতের রোমান আমলে নিয়ে যায়।
  নেপাল ভিসা খরচ কত তা জেনে নিন

সাধারণত ৩-৪ দিনের ভ্রমণেই এসব মূল দর্শনীয় স্থান ঘুরে দেখা সম্ভব। তবে যারা প্রকৃতি ভালোবাসেন তারা নৌভ্রমণ বা দ্বীপ ভ্রমণ যোগ করলে আরও ২-৩ দিন লাগতে পারে।

মোট খরচের একটি ধারণা

বাংলাদেশ থেকে ক্রোয়েশিয়া ভ্রমণ করতে চাইলে আনুমানিক ৭ দিনের জন্য যে খরচ লাগতে পারে তা নিচে উল্লেখ করা হলো।

খরচের ধরণ আনুমানিক খরচ
ভিসা ফি ও প্রসেসিং ১২,০০০ – ১৫,০০০ টাকা
রিটার্ন এয়ার টিকিট ৮০,০০০ – ১,১০,০০০ টাকা (ঢাকা থেকে জাগরেব, মৌসুম ও এয়ারলাইন্সভেদে দাম কমবেশি হতে পারে)
হোটেল (৭ রাত) ৫০,০০০ – ৮০,০০০ টাকা (৩ স্টার হোটেল, বাজেট হোস্টেল আরও কম)
খাবার ২৫,০০০ – ৩৫,০০০ টাকা (লোকাল রেস্টুরেন্টে খেলে সাশ্রয়ী, তবে মিড-রেঞ্জ রেস্টুরেন্টে খেলে খরচ বাড়বে)
লোকাল ট্রান্সপোর্ট ও ট্যুর ১৫,০০০ – ২৫,০০০ টাকা (ট্রান্সপোর্ট, এন্ট্রি ফি ও গাইডেড ট্যুরসহ)
মোট খরচ (প্রতি ব্যক্তি) প্রায় ১,৮০,০০০ – ২,৫০,০০০ টাকা

এই খরচ একটি গড় অনুমান। আপনি যদি বাজেট ট্রাভেলার হন তবে হোস্টেল, পাবলিক ট্রান্সপোর্ট ও মার্কেট থেকে খাবার কিনে রান্না করলে মোট খরচ ২০-৩০% পর্যন্ত কমানো সম্ভব। অন্যদিকে, যারা লাক্সারি হোটেল, প্রাইভেট ট্যুর ও শপিং করেন তাদের জন্য বাজেট ৩,০০,০০০ টাকার বেশি হতে পারে।

উপসংহার

ক্রোয়েশিয়া একটি স্বপ্নের গন্তব্য, তবে খরচ পরিকল্পনা করে গেলে ভ্রমণ অনেক বেশি সহজ ও উপভোগ্য হয়ে ওঠে। ভিসা থেকে শুরু করে ফ্লাইট, হোটেল, খাবার এবং দর্শনীয় স্থানের খরচ সম্পর্কে ধারণা থাকলে বাজেট তৈরি করা সহজ হয়।