
ইতালি ইউরোপের অন্যতম সুন্দর ও ঐতিহাসিক দেশ। ভেনিসের খাল, রোমের কলোসিয়াম কিংবা মিলানের ফ্যাশন সবকিছুই ভ্রমণপিপাসুদের কাছে এক স্বপ্নের দেশ। তবে ২০২৫ সালে ইতালিতে যাওয়ার আগে আপনার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হতে পারে ইতালিতে যেতে কত টাকা লাগে? আজ আমরা ধাপে ধাপে আলোচনা করব পর্যটক ভিসা, স্টুডেন্ট ভিসা এবং স্পন্সর ভিসার খরচসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় তথ্য।
ইতালিতে যেতে কত টাকা লাগে
ইতালিতে পর্যটক (Tourist) হিসেবে ভ্রমণ করতে গেলে আপনার প্রধান খরচগুলো হবে-
- ভিসা ফি: বর্তমানে শেনজেন ভিসার জন্য প্রায় ৮০ ইউরো লাগে, যা বাংলাদেশি টাকায় আনুমানিক ১০,০০০ টাকা। এই ফি একবারই দিতে হয় এবং এটি ফেরতযোগ্য নয়। ভিসা ফি-এর সাথে ভিসা সেন্টারের সার্ভিস চার্জও যুক্ত হতে পারে, যা আলাদাভাবে দিতে হবে।
- ভ্রমণ বিমা (Travel Insurance): শেনজেন ভিসার জন্য ট্রাভেল ইনস্যুরেন্স বাধ্যতামূলক। এটি সাধারণত ৬,০০০-১০,০০০ টাকার মধ্যে হয়ে থাকে এবং ভ্রমণের সময় কোনো দুর্ঘটনা, অসুস্থতা বা জরুরি পরিস্থিতিতে আর্থিক সুরক্ষা দেয়।
- ফ্লাইট টিকিট: মৌসুমভেদে টিকিটের দাম অনেক ওঠানামা করে। গ্রীষ্মকাল ও ছুটির সময় (জুন-আগস্ট ও ডিসেম্বর) টিকিটের দাম বেশি থাকে – ১,০০,০০০ টাকা বা তারও বেশি হতে পারে। তবে অফ-সিজনে বুক করলে ৬০,০০০-৮০,০০০ টাকায় রিটার্ন টিকিট পাওয়া সম্ভব। আগে থেকে বুকিং করলে সাশ্রয় হয়।
- হোটেল বুকিং: ইতালির শহরভেদে হোটেলের দাম আলাদা হয়। রোম, মিলান বা ভেনিসের মতো জনপ্রিয় শহরে প্রতি রাতের জন্য ৫০-১০০ ইউরো (৬,০০০-১২,০০০ টাকা) খরচ হতে পারে। বাজেট ট্রাভেল করলে হোস্টেল বা এয়ারবিএনবি বেছে নিয়ে খরচ কমানো যায়।
- খাবার ও দৈনন্দিন খরচ: রেস্তোরাঁয় খাওয়া হলে দিনে প্রায় ২০-৪০ ইউরো (২,৫০০-৫,০০০ টাকা) লাগতে পারে। সুপারমার্কেট থেকে খাবার কিনে খেলে অনেকটা সাশ্রয় করা যায়।
মোট খরচ: ৭-১০ দিনের একটি সাধারণ পর্যটক ভ্রমণের জন্য প্রায় ২-৩ লক্ষ টাকা লাগে (ফ্লাইট, হোটেল, খাবার, ভিসা ফি, ট্রাভেল ইনস্যুরেন্স সহ)। তবে মৌসুম, শহর এবং আপনার ভ্রমণ স্টাইল অনুযায়ী খরচ অনেকটা বাড়তেও পারে বা কমতেও পারে।
ইতালিতে স্টুডেন্ট ভিসায় যেতে কত টাকা লাগে
২০২৫ সালে ইতালিতে উচ্চশিক্ষা নিতে চাইলে খরচ কিছুটা বেশি হবে, কারণ আপনাকে সারা বছরের টিউশন ফি, থাকা, খাবার ও অন্যান্য ব্যক্তিগত খরচ বহন করতে হবে। সাধারণভাবে খরচের ধরন নিম্নরূপ:
- ভিসা ফি: প্রায় ৫০ ইউরো (৬,০০০ টাকা)। স্টুডেন্ট ভিসার জন্য প্রয়োজনীয় ডকুমেন্টেশন, ব্যাংক স্টেটমেন্ট এবং ভর্তি প্রমাণপত্র জমা দিতে হয়।
- ইউনিভার্সিটি টিউশন ফি: সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে বছরে প্রায় ১,০০০-৪,০০০ ইউরো (১-৫ লক্ষ টাকা) লাগে, যা ইউরোপের অন্যান্য দেশের তুলনায় তুলনামূলকভাবে কম। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে এই খরচ আরও বেশি – বছরে ৮,০০০ ইউরো বা তারও বেশি হতে পারে। অনেক বিশ্ববিদ্যালয় ইনকাম-ভিত্তিক রিডাকশন বা স্কলারশিপ দিয়ে খরচ কমিয়ে দেয়।
- ফ্লাইট টিকিট: সাধারণত ৭০,০০০-১,২০,০০০ টাকার মধ্যে হতে পারে। সেমিস্টারের আগে বুক করলে সাশ্রয়ী দাম পাওয়া সম্ভব।
- থাকা ও খাবার: ইতালিতে একজন শিক্ষার্থীর মাসিক জীবনযাত্রার খরচ গড়ে ৪০০-৭০০ ইউরো (৫০,০০০-৮০,০০০ টাকা)। এর মধ্যে রুম ভাড়া, ইউটিলিটি বিল, খাবার ও দৈনন্দিন খরচ অন্তর্ভুক্ত। বড় শহরে খরচ বেশি হয়, ছোট শহরে তুলনামূলকভাবে কম।
- হেলথ ইনস্যুরেন্স: বছরে প্রায় ১৫০ ইউরো (১৮,০০০ টাকা)। আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের জন্য স্বাস্থ্য বিমা বাধ্যতামূলক, যা জরুরি চিকিৎসা এবং হাসপাতালে ভর্তি খরচ কভার করে।
মোট খরচ: একজন স্টুডেন্ট হিসেবে প্রথম বছরের জন্য প্রায় ৮-১২ লক্ষ টাকা লাগতে পারে (টিউশন, থাকা, খাবার, বিমা, ফ্লাইট সহ)। স্কলারশিপ বা পার্ট-টাইম কাজ করলে এই খরচ অনেকটাই কমিয়ে আনা যায়।
ইতালিতে স্পন্সর ভিসায় যেতে কত টাকা লাগে
স্পন্সর ভিসা (Family Reunification বা Work Sponsorship) মূলত তখনই দেওয়া হয় যখন ইতালিতে আপনার পরিবারের সদস্য, স্বামী/স্ত্রী, বা কোনো নিয়োগকর্তা আনুষ্ঠানিকভাবে আপনাকে আমন্ত্রণ জানায়। এই ধরনের ভিসা সাধারণ পর্যটক বা স্টুডেন্ট ভিসার তুলনায় কিছুটা আলাদা, কারণ এখানে অনেক সময় আপনার আবাসন ও জীবিকা খরচ ইতালিতে থাকা ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান বহন করে। তবুও, আবেদনকারীকে কিছু প্রাথমিক খরচ নিজেই বহন করতে হয়।
প্রধান খরচগুলো হলো-
- ভিসা ফি: প্রায় ৫০-১০০ ইউরো (প্রায় ৬,০০০-১২,০০০ টাকা)। এই ফি ভিসা প্রসেসিংয়ের জন্য ইতালির দূতাবাস বা ভিসা অ্যাপ্লিকেশন সেন্টারে জমা দিতে হয়। ভিসার ধরন ও আবেদনকারীর বয়স অনুযায়ী ফি কিছুটা পরিবর্তিত হতে পারে।
- ফ্লাইট টিকিট: বাংলাদেশ থেকে ইতালির একমুখী ফ্লাইটের খরচ সাধারণত ৬০,০০০-১,০০,০০০ টাকা হয়। সিজন, এয়ারলাইন্স, এবং বুকিংয়ের সময় অনুযায়ী দাম ওঠানামা করে। আগাম বুকিং করলে অনেক সময় উল্লেখযোগ্য ডিসকাউন্ট পাওয়া যায়।
- ডকুমেন্ট প্রস্তুতি: অনুবাদ, অ্যাপোস্টিল, নোটারি এবং প্রয়োজনীয় প্রমাণপত্র তৈরির জন্য ১৫,০০০-৩০,০০০ টাকা পর্যন্ত লাগতে পারে। বিশেষ করে ইতালির দূতাবাস নির্দিষ্ট মান অনুযায়ী অনুবাদ ও লিগ্যালাইজেশন চায়, তাই এসব কাজ অবশ্যই স্বীকৃত এজেন্সি বা নোটারি পাবলিক থেকে করানো উচিত।
- অন্যান্য প্রসেসিং খরচ: এর মধ্যে ভ্রমণ বিমা, মেডিকেল চেকআপ, কুরিয়ার চার্জ এবং ভিসা সেন্টারের সার্ভিস ফি মিলিয়ে প্রায় ১০,০০০-২০,০০০ টাকা খরচ হতে পারে। ভ্রমণ বিমা সাধারণত কমপক্ষে এক বছরের জন্য করতে হয়, যদি আপনি দীর্ঘমেয়াদি ভিসা নিচ্ছেন।
স্পন্সর ভিসার সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো- যদি স্পন্সর ইতালিতে আপনার থাকার ব্যবস্থা ও দৈনন্দিন খরচ বহন করে, তাহলে আপনার মোট খরচ অনেকটাই কমে যায়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ১-২ লক্ষ টাকার মধ্যে পুরো প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা সম্ভব হয়।
ইতালিতে যাওয়ার আগে কিছু গুরুত্বপূর্ণ টিপস
- ডকুমেন্ট প্রস্তুত রাখুন: পাসপোর্ট (কমপক্ষে ৬ মাসের মেয়াদসহ), ব্যাংক স্টেটমেন্ট (শেষ ৬ মাসের), ভ্রমণ বিমা, হোটেল বুকিং বা আমন্ত্রণপত্র, এবং প্রয়োজনীয় অন্যান্য কাগজপত্র আগে থেকেই প্রস্তুত রাখুন। অসম্পূর্ণ বা ভুল ডকুমেন্টের কারণে ভিসা রিজেক্ট হতে পারে।
- আগাম ফ্লাইট বুক করুন: ভ্রমণের মৌসুম (সিজন) যেমন গ্রীষ্ম ও ছুটির সময়ে ফ্লাইটের দাম বেশি হয়। তাই অন্তত ২-৩ মাস আগে ফ্লাইট বুক করলে আপনি অনেক টাকা সাশ্রয় করতে পারবেন এবং ভালো সিটও পাবেন।
- সঠিক ভিসা টাইপ বেছে নিন: আপনি যদি পড়াশোনার জন্য যাচ্ছেন, তাহলে স্টুডেন্ট ভিসা; পরিবারের সাথে মিলিত হতে চাইলে ফ্যামিলি রিইউনিফিকেশন ভিসা; এবং চাকরির জন্য যাচ্ছেন, তাহলে ওয়ার্ক স্পন্সরশিপ ভিসা বেছে নিন। ভুল ভিসা টাইপ বাছাই করলে আবেদন বাতিল হতে পারে।
- ইতালির সংস্কৃতি ও আইন সম্পর্কে জানুন: ইতালি একটি সমৃদ্ধ সংস্কৃতির দেশ, তবে এখানে কঠোর আইনও রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, পাবলিক ট্রান্সপোর্টে টিকিট ছাড়া ভ্রমণ করলে জরিমানা হতে পারে। ভ্রমণের আগে ইতালির আইন ও সাংস্কৃতিক রীতিনীতি সম্পর্কে অনলাইনে রিসার্চ করা ভালো।
- বিশ্বস্ত ট্রাভেল এজেন্সির সহায়তা নিন: অভিজ্ঞ ট্রাভেল কনসালট্যান্ট বা ভিসা প্রসেসিং এজেন্সি বেছে নিলে আপনার ডকুমেন্ট প্রস্তুতি ও আবেদন প্রক্রিয়া অনেক সহজ হবে। অনেক ক্ষেত্রে তারা অতিরিক্ত পরামর্শ, ফর্ম পূরণ, এবং সাক্ষাৎকার প্রস্তুতিতেও সাহায্য করে, যা ভিসা অনুমোদনের সম্ভাবনা বাড়ায়।
উপসংহার
২০২৫ সালে ইতালিতে যাওয়ার খরচ আপনার ভ্রমণের উদ্দেশ্য, সময়কাল এবং ব্যক্তিগত পছন্দের উপর নির্ভর করবে। আপনি যদি সঠিক পরিকল্পনা, সঠিক ডকুমেন্টেশন এবং অভিজ্ঞ গাইডলাইনের মাধ্যমে প্রস্তুতি নেন, তাহলে আপনার ইতালি যাত্রা হবে অনেক সহজ ও আনন্দময়।